নিজস্ব প্রতিবেদক, তালা ::
তালা সার্জিক্যাল ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর পরিচালক বিধান চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ভূল আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট নিয়ে খবর প্রকাশে বেরিয়ে আসছে ডাক্তারের স্বাক্ষর জাল করে রিপোর্ট প্রদান থেকে শুরু করে ক্লিনিক ব্যাবসার অন্তরালে প্রতি নিয়ত রোগী সাধারণের সাথে প্রতারনার জানা অজানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ব্যাবসার অন্তরালে অপচিকিৎসা, নিজেই বিভিন্ন পরীক্ষা করে বিভিন্ন ডাক্তারের নামে রিপোর্ট প্রদানসহ বিভিন্ন সময় নানা অনিয়মের খবর প্রকাশ হলেও কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কার্যত কোন প্রকার ব্যাবস্থা গ্রহন করেননি। মূলত প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যাবস্থা না নেওয়ায় আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তারা।
এরই ধারবাহিকতায় কখনো উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: রাজিব সরদারের স্বাক্ষর জাল কিংবা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ডাক্তারের স্বাক্ষর জাল করে আল্ট্রাসনোসহ বিভিন্ন রিপোর্ট তৈরী করেছেন কথিত ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। কখনো কখনো লোকাল মিডিয়া স্বোচ্চার হলে নিজেই ডিএমএফ/ সিএমইউ ট্রেনিং নিয়ে কিন্তু সেটাও কতটা আইনসিদ্ধ তার বার্তাবহন করছে প্রতিনিয়ত ভূল রিপোর্ট প্রদান।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার দক্ষিণ আরশনগর গ্রামের হাচিম আলী জোয়াদ্দারের কন্যা মোছা: হালিমা খাতুন (৩৮) ২০২০ সালের ১ মার্চ তালা সার্জিক্যাল ক্লিনিকে গর্ভজাত সন্তানের অবস্থান দেখার জন্য আল্ট্রাসনো করান। উক্ত আল্ট্রাসনো রিপোর্টে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: রাজিব সরদারের স্বাক্ষর দেখানো হয়। অতপর একই দিনে হালিমার অবৈধভাবে গর্ভপাত করান কথিত ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়।
এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে হালিমা বেগম বাদী হয়ে গর্ভপাতের অভিযোগে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন নিজ স্বামী, দেবরসহ আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে। ঐ সময় মামলাটি তদন্তের জন্য তালা হাসপাতালে উপর নির্দেশ প্রদান করেন। যার প্রেক্ষিতে তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্তে প্রতিয়মান হয় যে, আল্ট্রাসনো রিপোর্টের স্বাক্ষরটি ডা. রাজিব সরদারের নয় এছাড়া ডা: রাজিব সরদার আলাদা পত্রে আদালতকে অবহিত করেন যে, গত ১/৩/২০২০ ইং তারিখে হালিমা খাতুনের (৩৮) নামে তালা সার্জিক্যাল ক্লিনিক তাদের আল্ট্রাসনো রিপোর্ট-এ স্বাক্ষরটি তার নয়।
এছাড়া প্রায় ৪ মাস পূর্বে কাশিমনগর এলাকার এক ভাংড়ি ব্যাবসায়ীর স্ত্রী খানপুর এলাকার মেয়ে অন্ত:সত্ত্বা রেখা বেগমকে সেখানে আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে নিলে রিপোর্টে জমজ সন্তানের বিভ্রান্তিকর তথ্য ও পরে গর্ভজাত সন্তানকে মৃত ঘোষণা করে গর্ভপাত করায়। এরপর দীর্ঘ দিনেও তার রক্ষক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় অন্যত্র চিকিৎসা নিয়ে কোন রকম সুস্থ্য হন তিনি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, তালা সার্জিক্যাল ক্লিনিক সরকারি নিয়ম নীতিমালা উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট আবাসিক ডাক্তার কিংবা সার্জন ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালের সার্জন দিয়ে চুক্তিভিত্তিক অপারেশন করিয়ে ক্লিনিক পরিচালনা করা হচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ নয়। ক্লিনিক ব্যাবসার পাশাপাশি খুলে বসেছেন আরেক প্রতারণার ফাঁদ ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ক্লিনিক মালিক বিধান চন্দ্র রায় নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে সেখানে রোগী গেলেই বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষার ফাঁদে ফেলে নিজ ডায়াগনস্টিকে নিজেই পরীক্ষা করেন। সেক্ষেত্রে পূর্বে বিভিন্ন ডাক্তারের স্বাক্ষর জাল করে রিপোর্ট প্রস্তুত করলেও এখন নিজে ডিএমএফ/সিএমইউ ট্রেনিং নিয়ে নিজের নাম স্বাক্ষর করছেন। যদিও নীতিমালা অনুযায়ী আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষায় ¯েœালোজিষ্ট হিসেবে একজন এমবিবিএস ডাক্তার থাকার কথা।
অনাড়ী হাতুড়ে কথিত ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি মা-সহ একের পর এক রোগীর মৃত্যুতেও হুশ হচ্ছেনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
সরকারি নিয়মানুযায়ী, উপজেলা পর্যায়ে একটি ক্লিনিকে ৯টি বেড, ১জন সার্জন, ১জন আবাসিক মেডিকেল অফিসার, ১জন ডিপ্লোমাসহ ৫জন নার্স, প্রশিক্ষিত ওয়ার্ডবয় থাকার কথা থাকলেও তার কোন শর্ত পূরণ নেই ক্লিনিকটিতে। সেখানে আগত রোগী সাধারণকে কথার ফুলঝুরিতে ভুলিয়ে নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা এরপর অপারেশন টেবিলে উঠিয়ে শুরু বিভিন্ন নাটক। কখনো কখনো রোগী মৃত্যু কিংবা আশংকাজনক অবস্থায় অন্যত্র রেফার কিংবা অন্তিম সময়ে রোগীর পরিবারকে ম্যানেজ করেই চলছে ক্লিনিকের কার্যক্রম।
সর্বশেষ খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির সিলেমানপুর গ্রামের মৃত ফরিদ সানার নবম শ্রেণিতে পড়–য়া মেয়ে রেশমি খাতুন (১৫) অসুস্থ্য হলে গত ১৬ আগস্ট তাকে ঐ ক্লিনিকে নিলে বিধানের পরামর্শ মতে সেখানে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়। যাতে (এ্যাপেন্ডিকুলার লাম্প) ধরা পড়ে। এরপর ঘটনার শিকার রেশমির মা আকলিমা বেগম মেয়েকে নিয়ে প্রথমে পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৩ দিন পর ১৯ আগস্ট স্থানীয় রাসেল ক্লিনিকে অপাশেনের জন্য ওটিতে উঠিয়ে সিজারের পর দেখা যায়, তার এ্যাপেন্ডিস নয় বরং খাদ্যনালীতে বড় ধরনের টিউমার হয়েছে।
এসময় সংশ্লিষ্ট সার্জন তার অপারেশন না করেই ফের সেলাই করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। তবে অর্থাভাবে তাকে ঢাকায় না নিয়ে খুলনার একটি ক্লিনিন থেকে ৩ মাসের ব্যাবস্থপত্রসহ বাড়িতে চিকিৎসা করানো হচ্ছিল। অপচিকিৎসার এমন খবর স্থানীয় একাধিক মিডিয়ায় প্রকাশ পেলে বিধান লোকাল লবিষ্ট নিয়োগ করেন বিষয়টি রেশমির পরিবারের সাথে স্থানীয়ভাবে মিমাংশার জন্য। এক পর্যায়ে গত ২৯ আগস্ট স্থানীয়দের মাধ্যম ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে আপোষনামা লেখাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের ভুল স্বীকার করে রেশমির ক্ষতিপূরণ বাবদ মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে বিষয়টির রফা করেন ক্লিনিক মালিক বিধান চন্দ্র রায়।
এসব ব্যাপারে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টি সেন্টারের মালিক বিধান চন্দ্র রায়ের কাছে তার ব্যাবহৃত মোবাইলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্য নয়। এমনকি তিনি নিজেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডিএমএফ/ সিএমইউ পরিচয় দিয়ে আল্ট্রসনোগ্রাম পরীক্ষা ও রিপোর্টে নিজের স্বাক্ষর করতে পারবেন বলে দাবি করেন। যদিও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। (চলবে)